রাজধানী ঢাকায় গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন বাজারে সরকার নির্ধারিত পাঁচটি নিত্যপণ্যের নতুন দাম কার্যকর হতে দেখা যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়। এ ছাড়া চিনির দাম আগেই নির্ধারণ করা ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ওই দিন এই পাঁচ পণ্যের নির্ধারিত দামের কথা উল্লেখ করে বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে তা কার্যকর হবে।
সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ডিম প্রতিটি ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকা, প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা দামে বিক্রি হওয়ার কথা। এ ছাড়া খোলা চিনি প্রতি কেজি ১২০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা এবং প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৯ টাকা, খোলা তেল ১৪৯ টাকা ও পাম তেল ১২৪ টাকায় বিক্রি করার কথা।
গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুর, তালতলা ও কারওয়ান বাজারে ঘুরে উল্লিখিত দামে কোথাও এসব পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়নি। আমদানি ও সরবরাহ না বাড়ালে সরকার এবারও পাঁচ পণ্যের দাম কমিয়ে আনতে পারবে না বলে দাবি করেছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও ব্যবসায়ীরা।
এর আগেও সরকার থেকে নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করার পর তা কার্যকর হতে দেখা যায়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে খোলা চিনি ১০৭ থেকে কমিয়ে ১০৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু সেই দাম ব্যবসায়ীরা মানেননি। তখন বাজারে চিনি ১১২ থেকে ১১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
এরপর গত জুনে সরকার প্রতি কেজি চিনিতে ১৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু সেই দামও কার্যকর হয়নি। এখন বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। আলুর দাম সরকার গত ছয় মাসের মধ্যে এই প্রথম নির্ধারণ করে দিল।
গত আগস্টে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সয়াবিন তেলের দাম কমিয়েছিল।
তখন বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭৯ টাকা থেকে পাঁচ টাকা কমিয়ে ১৭৪ টাকা এবং খোলা তেল ১৫৯ থেকে কমিয়ে ১৫৪ টাকা করা হয়েছিল।
খুচরা বাজারে ৫ পণ্যের দাম
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তালতলার আবুল বাশার মার্কেটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলু ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ৭০ টাকা, ডিম প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৩ টাকা, খোলা চিনি ১৪০ টাকা কেজি, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৪ টাকা।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাজারের কেরানীগঞ্জ জেনারেল স্টোরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছিল ৯০ টাকা কেজি দরে।
এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জিয়াউল হকের কাছে পণ্যের দাম বেশি রাখার কারণ জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কাল (বৃহস্পতিবার) রাতে কারওয়ান বাজার থেকে ৮০ টাকা কেজিতে দেশি পেঁয়াজ কিনেছি। যাতায়াত খরচ আছে। কাজেই ৯০ টাকার কমে পোষায় না।’
তিনি বলেন, ‘আলু ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।’ সরকার নির্ধারিত নতুন দাম ৩৬-৩৭ টাকা কেজির কথা বললে জিয়াউল হক বলেন, ‘কাঁচামাল আসলে দাম নির্ধারণ করে ধরে রাখা যায় না। এটা কাল নির্ধারিত হয়েছে। নতুন মাল এলে দাম কমবে। আমি তো বেশি দামে কিনেছি। মেমো আছে। আমাদের প্রতি ডজন ডিম ১৪৭ টাকার ওপরে কেনা পড়েছে। বিক্রি করছি ১৫০ টাকা ডজন দরে।’
মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি, দেশি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি, ডিম ১৫০ টাকা ডজন বা প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এই বাজারের ব্যবসায়ী মো. মিজান বলেন, এগুলো শুধু শুধু দাম নির্ধারণ। এগুলো কোনো কাজে আসবে না।
এই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মাইজুদ্দিন দোকানে দামের তালিকা ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিনি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৬৫ টাকা কেজি এবং দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৮০ টাকা কেজি দরে। দাম কমানোর বিষয়ে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘মানুষ সৎ হলে দাম কমবে।’
পাইকারি বাজারে দাম
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, সব পণ্যই আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। দাম নির্ধারণের প্রভাব নেই। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোল্ড স্টোরেজে বেশি দাম রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আমদানি খরচ বেশি। এর সঙ্গে সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য দাম কমছে না।
ডিম
এই বাজারে লাল ডিম প্রতি ডজন ১৪৫ টাকা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বিক্রেতা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা তেজগাঁও স্টেশন থেকে ডিম কিনে আনি। আগের চেয়ে একটু কমেছে।’
আলু
কারওয়ান বাজারে আড়ত ও খুচরা উভয় দামেই আলু পাওয়া যায়। এই বাজারের বিক্রমপুর ভাণ্ডারের আড়তদার ওয়াহেদ শেখ লাল আলু বিক্রি করছেন ৪০ টাকা কেজি দরে। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে গোড়ায় যাই (কোল্ড স্টোরেজে)। ওখান থেকে কমে আনলে, আমরা কমে বিক্রি করব। এগুলো আগের দামে কেনা। এগুলো শেষ হয়ে গেলে কমে পেলে কমে বিক্রি করব।’
পেঁয়াজ
কারওয়ান বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছিল ৫৫ টাকা কেজি এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি। মিনহাজ বাণিজ্যালয়ে পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। এই আড়তের মালিক মো. খলিল মল্লিক বলেন, ‘পেঁয়াজ যারা চাষ করে, তারা কম দামে ছাড়ছে না। আমাদেরও বেশি দামে আনতে হয়। ফলে দাম বেশি বিক্রি করতে হয়।’
নির্ধারিত দাম কার্যকর হবে কিভাবে
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, তেলের বোতলে এমআরপি লিখে সেটা তো বাজারে আসার সময় দিতে হবে। একটু অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ডিমের দাম ১৫ টাকা পিস উঠেছিল। আমরা অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ টাকায় নিয়ে এসেছি। এখন ১২ টাকা করতে গেলে সেটা ফার্ম পর্যায়ে সাড়ে ১০ টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। এটা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে দেখতে বলুন।’
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আলু কোল্ড স্টোরেজের গেটে ৩৯, ৪০, ৪১ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এখন হিমাগারে এটা ঠিক করার জন্য একটু সময় দিতে হবে। ডিসিদের ইনভলভ করা হচ্ছে। আমাদের অফিসাররা তো যাচ্ছে। আমি কাল মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছি। এরপর বগুড়া, রংপুর যাব। এটার ক্ষেত্রে চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে। কোল্ড স্টোরেজের আলুর দাম ২৭ টাকায় নামাতে হবে। ওখানে কমলে ভোক্তা পর্যায়ে আমরা ৩৬ টাকায় আনতে পারব। ওরা যদি কম দামে না রাখে তখন কোল্ড স্টোরেজের সব আলু সিজ করে নিলামে বিক্রি করব।’
তিনি বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ যেটা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেটা ১৫ টাকা কমাতে হলে ফরিদপুর এবং পাবনার হাটগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা খুব দ্রুত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডিসিদের সঙ্গে জুমে মিটিং করব।’
এ ব্যাপারে ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বাজার স্থিতিশীল রাখতে মোবাইল কোর্ট, যৌথ অভিযান ও বাজার পরিদর্শন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েকটি পণ্যের দাম নির্দিষ্ট রাখার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। সরকারের নির্দেশনা পেলে ব্যবস্থা নেব।’
খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে মনিটরিং নজরদারি বাড়ানো হবে। ভোক্তা অধিকারসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বাজার পরিদর্শন করা হচ্ছে।’
ভোক্তাদের সংগঠন যা বলছে
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করছেন। এই প্রেক্ষাপটে সরকার হিসাব-নিকাশ করে মুনাফা ঠিক করে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা যৌক্তিক মনে হচ্ছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার জন্য যে কারণ আছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ না করলে অটোমেটিক্যালি নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন করা যাবে না।
তদারকি বাড়াতে বলছেন আমদানিকারকরা
চিনি-তেল আমদানিকারক ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) তাসনিম শাহরিয়ার বলেন, ‘খোলাবাজারে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। আমরা ঠিকমতো সরবরাহ করছি। এখানে কোনো সংকট নেই। সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। প্যাকেট চিনির দাম লেখা আছে। প্যাকেট চিনি কেউ ১৩৫ টাকার বেশি নেবে না।’