কখনও গ্রামের প্রকৃতি– নদী, অগ্রহায়ণের ফসলের মাঠ, শরতের নীল আকাশ; কখনও বই হাত স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা, মাঠে কাজ করছে কৃষক; কখনও বাঘের থাবা, সিনেমার দৃশ্য– এসবই ফুটে ওঠে রিকশাচিত্রে। বাংলার আবহমান ঐতিহ্য ধারণ করে এসব রিকশার চাকা ঘোরে গ্রামের ছোট্ট বাজার বা রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে। রিকশা ও রিকশাচিত্র যেন একে অন্যের পরিপূরক।
অবশেষে ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র স্বীকৃতি পেয়েছে। গতকাল বুধবার আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানার কাসানে ১৮তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিষদের সভায় এ বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জামদানি বুনন শিল্প, শীতলপাটি বুনন শিল্প, বাউল গান ও মঙ্গল শোভাযাত্রার পর ছয় বছর বিরতিতে দেশের পঞ্চম অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র’ স্বীকৃতি পেল।
কাসান শহরে গত সোমবার শুরু হয় ইউনেস্কোর আন্তঃসরকার কমিটির ওই অধিবেশন। বুধবার প্রায় তিন ঘণ্টার অধিবেশনে উপস্থাপন করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমূর্ত ঐতিহ্য। এ সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও দেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মুহম্মদ তালহা ও দূতাবাসের প্রথম সচিব ওয়ালিদ বিন কাশেম।
এ অধিবেশন ইউনেস্কোর ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় শুরু হয় অধিবেশন। এতে বাংলাদেশের রিকশা ও রিকশাচিত্র নিয়ে তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, ঢাকা শহরের তিন চাকার এ বাহনে থাকে নানা রঙের বৈচিত্র্য। বাহন হিসেবে শহরের মানুষের প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে রিকশা। একই সঙ্গে উল্লেখ করা হয়, রিকশাচিত্র শুধু একটি শিল্প নয়; এটি মানুষের সমকালীন জীবনের গল্প বলার চলমান ক্যানভাস। রিকশাচিত্রের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে শুরু করে নানা বিষয়ের মধ্যে চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের মুখচ্ছবিও উঠে আসে।
গত ছয় বছর এ চিত্রকর্মের নিবন্ধন ও স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ২০২২ সালে আবার নথি জমা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় পুরো নথিটি নতুন করে প্রস্তুত করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও সচিব খলিল আহমদ এ অর্জনকে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া নিবন্ধন ও স্বীকৃতি প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ও প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসকে অভিনন্দন জানান।
বাংলাদেশের রিকশাচিত্র ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সভায় উপস্থিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্য, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে অভিনন্দন জানান। এ চিত্রকর্মের বৈচিত্র্যপূর্ণ বহিঃপ্রকাশে তাদের সন্তুষ্টির প্রকাশ করেন। এ অর্জনের মাধ্যমে ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের ধারাবাহিক সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হলো।
গত ১৫ নভেম্বর ৪২তম সাধারণ পরিষদের সভায় বাংলাদেশ ইউনেস্কো নির্বাহী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের এ ধারাবাহিক সাফল্যকে সংশ্লিষ্ট মহল দেশের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেন। জানা যায়, অন্তত আট দশক ধরে দেশে রিকশাচিত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
‘বিমূর্ত ঐতিহ্যের সুরক্ষা’ স্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া ইউনেস্কোর এ অধিবেশনে এবার আরও স্বীকৃতি পেয়েছে ভারতের গরবা, মধ্যপ্রাচ্যের হারিসসহ সাতটি ঐতিহ্য। কিউবা, মেক্সিকোর বলেরোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরও বেশ কিছু বিমূর্ত ঐতিহ্য স্বীকৃতি পেয়েছে।