আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। প্রতিদিন নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে চলছে এডিস মশাবাহিত এ রোগ। মশক নিধন কার্যক্রমে গতি না থাকায় আগামী মাসে ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য আবহাওয়াগত কারণে নভেম্বরে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমে গেলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও কমতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
রাজধানীসহ সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় নির্মাণাধীন ভবন, বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে চলমান উন্নয়ন কাজ, ডাবের খোসা, একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিক সামগ্রীতে পানি জমা হচ্ছে। তাছাড়া ফুলের টব, এসিসহ বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা হচ্ছে। এসব জমা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে। একদিকে প্রজননের অনুকূল পরিবেশ, অন্যদিকে মশক নিধন কার্যক্রমে ভাটার সুযোগে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকা হয়ে উঠছে ডেঙ্গুর হটস্পট।
ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যুর শীর্ষে ডিএসসিসি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছর (গত বুধবার পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে ১১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত্যুর ৮১ জনই মারা গেছে ঢাকায়। তাদের মধ্যে ৬৭ জন ডিএসসিসি এলাকার এবং ১৪ জন মারা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮ জন, বরিশালে ১১, ঢাকা বিভাগে (সিটি এলাকা বাদে) ৩, খুলনায় ৫ এবং ময়মনসিংহে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
আক্রান্তের দিক থেকেও শীর্ষে রয়েছে ডিএসসিসি এলাকা। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২১ হাজার ৯৭ জন। এর মধ্যে ডিএসসিসি এলাকায় ৫ হাজার ১৯৫ জন, চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৯৩৪, ডিএনসিসি এলাকায় ৩ হাজার ৬৯৩, বরিশালে ১ হাজার ৯৯২ এবং খুলনায় ১ হাজার ৪৪১ জন আক্রান্ত হয়েছে।
মশক নিধন কার্যক্রম নেই : গত কয়েক বছর ধরে প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর ফলে মৌসুমের শুরু থেকেই নড়েচড়ে বসে মশক নিধনের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান, মসজিদে নামাজের পর ইমামের সচেতনতামূলক বয়ান, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি করে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে প্রচারণা, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার এবং লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া মূল কার্যক্রম হিসেবে সকাল-বিকেল মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু এবার জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দেন জনপ্রতিনিধিরা। ঢাকার দুই মেয়রের চেয়ারে প্রশাসক বসানো হলেও ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে শতাধিক কাউন্সিলর এখনো এলাকায় ফেরেননি। ছয়জন সংরক্ষিত কাউন্সিলরসহ ১৬ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বর্তমানে মাঠে রয়েছেন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বারবার এডিস মশা নিধনে কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রশাসনিক স্থবিরতার সুযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছে। এলাকাবাসী গত দুই-তিন মাস ধরে কোনো মশককর্মীকে মাঠে দেখছে না।
মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল হাসান বলেন, শুধু জুলাই মাসের পর নয়, জুন মাস থেকে এই এলাকায় কোনো মশক নিধন হয়নি।
শাখারী বাজার এলাকার বাসিন্দা গণি মোড়ল বলেন, কাউন্সিলর ব্যস্ত ছিলেন দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে। মশার কামড়ে কে মারা গেল, কে বাঁচল, এটা তাদের দেখার বিষয় না। এখন যারা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে আসছে তারা যদি মশার কামড় থেকে মানুষকে না বাঁচাতে পারে, তাদেরও দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত।
সব এলাকায় এডিস মশার লার্ভা, ডেঙ্গু আরও বাড়বে : মশার লার্ভা পরিমাপের একককে ব্রুটো ইনডেক্সে বলা হয়। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কোনো এলাকাতেই এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের হার ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর নিচে নেই। এই অবস্থাকে আশঙ্কাজনক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন গবেষকরা। ফলে আগামী মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার দেশ রূপান্তরকে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু বাড়বে। এখন পুরো ঢাকায় মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার না করলে অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। অবশ্য নভেম্বরে প্রাকৃতিকভাবেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে আসবে।
তিনি বলেন, আমরা প্রতি মাসেই মাঠপর্যায়ের জরিপ এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মশার পূর্বাভাস তৈরি করি। এবারের পূর্বাভাসে ভালো কিছু নেই। এভাবে মশক নিধন চলতে থাকলে আগামী অক্টোবর মাসে আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে ডেঙ্গু।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মাসে সমন্বয় সভা করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সেখানে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সভা শেষে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ জানিয়েছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে এতে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার মসজিদ এবং মন্দিরসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনার পর সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মহ. শের আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শে মশক নিধনে সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। মানুষকে ডেঙ্গু থেকে মুক্ত রাখার জন্য আমাদের সব চেষ্টাই চলমান আছে।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার থেকে ডিএনসিসির সব অঞ্চলে একযোগে মশক নিধন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। যা চলবে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আজ সকালে মেরুল বাড্ডায় এ কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন ডিএনসিসির প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান। জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৃষ্টি হলে মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তাই মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। খালসহ অন্যান্য জলাশয় পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া জনসচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছি।