শেষ বলে ৪ রানের প্রয়োজনে কোন রানই নিতে পারলেন না বাংলাদেশের অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। আর তাতেই আশা ভরসা শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সপ্তম আসরে সুপার টুয়েলভে গ্রুপ-১এর নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৩ রানে হারলো বাংলাদেশ। সুপার টুয়েলভে টানা তিন ম্যাচের হারে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার আশা বলতে গেলে শেষ হয়ে গেল টাইগারদের। প্রথম দুই ম্যাচে শ্রীলংকা ও ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিলো বাংলাদেশ। অন্য দিকে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে এসে প্রথম জয়ের মুখ দেখলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ম্যাচে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৪২ রান করেছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১৩৯ রান করে হ্যাট্টিক হার বরণ করে বাংলাদেশ।
একাদশে থেকে দু’টি পরিবর্তন এনে শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সুপার টুয়েলভে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নামে বাংলাদেশ। নুরুল হাসান ও নাসুম আহমেদের পরিবর্তে একাদশে সুযোগ পান সৌম্য সরকার ও তাসকিন আহমেদ। টস জিতে প্রথমে বোলিং করতে নামে বাংলাদেশ।
তৃতীয় ওভারেই প্রথম সাফল্য পেতে পারতো বাংলাদেশ। মুস্তাফিজুর রহমানের বলে পয়েন্টে ঠেলে রান নিতে দৌঁড় দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার ক্রিস গেইল। কিন্তু অপরপ্রান্তে গেইলের ডাকে সাড়া দেননি আরেক ওপেনার এভিন লুইস। পয়েন্টে থাকা সাকিব আল হাসান বল থ্রো করেছিলেন, কিন্তু তার থ্রো স্টাম্প খুঁজে পায়নি। ফলে এ যাত্রায় বেঁচে যান গেইল।
তবে একই ওভারের শেষ বলে উইকেট শিকারের আনন্দে ভাসে বাংলাদেশ। ফিজের লেগ স্টাম্পের বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে আকাশে তুলে দেন ৯ বলে ৬ রান করা লুইস। স্কয়ার লেগে সেই ক্যাচটি নেন মুশফিকুর রহিম।
নিশ্চিত রান আউট থেকে বাঁচলেও চতুর্থ ওভারে বিদায় ঘন্টা বাজে গেইলের। দ্বিতীয়বারের মত আক্রমনে এসে গেইলকে বোল্ড করেন স্পিনার মাহেদি হাসান। ১০ বল খেলে ৪ রান করে আউট হন আত্মস্বীকৃত ইউনিভার্স বস।
বাংলাদেশী বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং পাওয়ার-প্লেতে সুবিধা করতে না পারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২ উইকেটে ২৯ রান সংগ্রহ করে।
এ অবস্থায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের চাপ আরও বাড়িয়ে দেন মাহেদি। সপ্তম ওভারের চতুর্থ বলে মাহেদির বলে লং-অফে সৌম্যকে হাতে ক্যাচ দেন ৭ বলে রা৯ রান করা শিমরোন হেটমায়ার। এতে ৩২ রানে ৩ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অবশ্য উইকেট সংখ্যাটা ৪ হতে পারতো। একই ওভারের তৃতীয় বলে রোস্টন চেজ ক্যাচ দিয়েছিলেন মাহেদিকে। তবে সেটি ধরতে পারেনি টাইগার স্পিনার।
দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে লড়াইয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন চেজ ও অধিনায়ক কাইরন পোলার্ড। বড় জুটির প্রয়োজনে সর্তকতার সাথে খেলছিলেন তারা। হেটমায়ারের আউটের পর ২৩ বলে কোন বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মুস্তাফিজুরের করা ১১তম ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি মারেন অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা চেজ। এ সময় বল হাতে উইকেট নিতে না পারলেও, কৃপণ ছিলেন দলের সেরা খেলোয়াড় সাকিব। ২ ওভারে মাত্র ৭ রান দেন তিনি।
১৩তম ওভারে আক্রমনে আসেন বাংলাদেশের পেসার তাসকিন। ঐ ওভারের তৃতীয় বলে ১ রান নিতে গিয়ে অসুস্থতায় আহত অবসর নেন পোলার্ড। ১৬ বল খেলে ৮ রান করেন তিনি।
পোলার্ডের জায়গায় ব্যাটিংয়ে আসেন আন্দ্রে রাসেল। আগের বলে পোলার্ড ১ রান নেয়ায় নন-স্ট্রাইকেই থাকতে হয় রাসেলকে। দুভার্গ্য সেখানেই পেয়ে বসে রাসেলকে।
তাসকিনের ডেলিভারিতে বোলার ব্যাক-ড্রাইভ শট নিয়েছিলেন চেজ। সেই শটে বল পায়ে লাগিয়ে নন-স্ট্রাইকের উইকেট ভাঙ্গেন তাসকিন। তখন লাইনের বাইরে ছিলেন রাসেল। তাতে রান আউট হন রাসেল। তাই কোন বল না খেলেই খালি হাতে ফিরেন বিগ হিটার রাসেল। ৬২ রানে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন রাসেল।
পরের ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চাপ আরও বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করেছিলেন সাকিব। দ্বিতীয় ডেলিভারিতে স্লগ-সুইপ করেছিলেন চেজ। বল হাওয়ায় ভাসলেও মিড উইকেটে সেই ক্যাচ ফেলেন মাহেদি। তখন ২৮ রানে ছিলেন চেজ।
একই ওভারে আবারো উইকেট পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয় সাকিবের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিকোলাস পুরান উইকেটে ছেড়ে আসায় চতুর্থ ডেলিভারিটি ওয়াইড দিয়েছিলেন সাকিব। এতে স্টাম্পের সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি উইকেটরক্ষক লিটন দাস। ফরে ব্যক্তিগত ৩ রানে জীবন পান পুরান।
জীবন পেয়ে মারমুখী হয়ে উঠেন পুরান। সাকিবের করা ১৬তম ওভারের প্রথম দুই বলে ছক্কা মারেন তিনি। ১৮তম ওভারে মাহেদিকেও দু’টি ছক্কা হাঁকান পুরান।
এতে ১৮ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১১৯ রান পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাই শেষ দুই ওভারে পুরান ও চেজের কাছ থেকে চার-ছক্কার ঝড় দেখায় অপেক্ষায় ছিলো ক্যারিবীয়রা। যাতে বাংলাদেশের সামনে লড়াকু দেয়া যায়।
কিন্তু ১৯তম ওভারের প্রথম দুই বলে পুরান ও চেজের বিদায় নিশ্চিত করেন বাংলাদেশের বাঁ-হাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। ডিপ কভারে নাইমকে ক্যাচ দেন পুরান। আর বোল্ড হন চেজ। ২২ বলে ১টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৪০ রান করেন পুরান। ৪৬ বলে ২টি চারে ৩৯ রান করেন চেজ। পঞ্চম উইকেটে ৫৭ রান যোগ করেন তারা।
ইনিংসের শেষ ওভারে বল হাতে নিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। প্রথম বলে ডোয়াইন ব্রাভোকে শিকার করেন ফিজ। কিন্তু পরের দুই বলে ছক্কা আদায় করে নেন জেসন হোল্ডার। ব্রাভোর আউটে উইকেটে আসেন আহত অবসর নেয়া পোলার্ড। শেষ বলে ছক্কায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ করেন পোলার্ড। ফলে শেষ ওভার থেকে ১৯ রান তুলেন হোল্ডার ও পোলার্ড। এতে ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৪২ রানের লড়াকু স্কোর পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
হোল্ডার ৫ বলে ২টি ছক্কায় অপরাজিত ১৫ এবং পোলার্ড ১টি ছক্কায় অপরাজিত ১৪ রান করেন। বাংলাদেশের মাহেদি-মুস্তাফিজুর-শরিফুল ২টি করে উইকেট নেন। উইকেটশুন্য ছিলেন তাসকিন ও সাকিব। ৪ ওভার করে বল করে তাসকিন ১৭ ও সাকিব ২৮ রান দেন।
জয়ের জন্য ১৪৩ রানের টার্গেটের জবাব দিতে ওপেনিংয়ে পরিবর্তন আনে বাংলাদেশ। লিটনের পরিবর্তে ওপেনার হিসেবে নাইমের সাথে ক্রিজে আসেন সাকিব। টি-টেয়েন্টি ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে এই প্রথম ওপেনিংয়ে নামলেন সাকিব।
সাকিবের ব্যাট থেকেই বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারি আসে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হোল্ডারের বলে কভারের উপর দিয়ে বাউন্ডারি মেরে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেন সাকিব। তৃতীয় ওভারের প্রথম বলে চার মারেন নাইম। তাই নাইম-সাকিবের কাছ থেকে ভালো শুরুর ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমিরা।
কিন্তু পঞ্চম ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনার আকিল হোসেইনের বলে মিড-অফে হোল্ডারকে ক্যাচ দিয়ে আউট হন সাকিব। ১২ বলে ৯ রান করেন তিনি।
সাকিবের পর আরেক ওপেনার নাইমও দ্রুত বিদায় নেন। পরের ওভারে নাইমকে বোল্ড করেন হোল্ডার। ১৯ বলে ২টি চারে ১৭ রান করেন নাইম।
২৯ রানে ২ উইকেট হারানো বাংলাদেশ এ ম্যাচেও পাওয়ার-প্লের সুবিধা নিতে পারেনি। ৬ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৩৪ রান তুলে তারা।
শুরুর ধাক্কাটা সামলে উঠতে বড় জুটি চেষ্টা করেন তিন নম্বরে নামা লিটন ও চার নম্বরে নামা সৌম্য। ২৯ বলের জুটিতে মাত্র ৩টি চার মারেন লিটন-সৌম্য। এতে ১০ দশমিক ৩ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৬০ রান। ঐ ওভারের চতুর্থ বলে হোসেইনের বলে গেইলকে ক্যাচ দিয়ে থামেন সৌম্য। ২টি চারে ১৩ বলে ১৭ রান করেন তিনি। দ্বিতীয় উইকেটে ৩০ বলে ৩১ রান যোগ করেন তারা।
এরপর নিজের উইকেট বিলিয়ে দেন মুশফিকুর রহিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার রবি রামপলকে স্কুপ শট খেলতে গিয়ে বোল্ড হন ৮ রানে থাকা মুশফিক। ১৪তম ওভারে উইকেটে আসেন মাহমুদুল্লাহ। আর ১৬ ওভার শেষে বাংলাদেশের জিততে দরকার পড়ে ৩৩ রান।
১৭তম ওভারে আসে ৩ রান। ১৮তম ওভারে লিটনের চারে বাংলাদেশ পায় ৮ রান। এমন অবস্থায় ২ ওভারে ২২ রানের দরকার পরে বাংলাদেশের। ছক্কা দিয়ে ব্রাভোর করা ১৯তম ওভারের শুরুটা দারুন করেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। কিন্তু শেষ বলে বাউন্ডারি লাইনে হোল্ডারের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হন লিটন। ৪৩ বলে ৪টি চারে ৪৪ রান করেন লিটন। এতে শেষ ওভারে ১৩ রানের প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশের।
শেষ ওভারের প্রথম পাঁচ বলে কোন বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি ছাড়া বাংলাদেশ নিতে পারে ৯ রান। তাই শেষ বলে ৪ রানের দরকারে, ব্যর্থ হন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। শেষ বল ডট হওয়াতে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১৩৯ রান তুলে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।
২৪ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় অপরাজিত ৩১ রান করেও দলকে জেতাতে পারেননি মাহমুদুল্লাহ। ২ রানে অপরাজিত থাকেন আফিফ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রামপল-হোল্ডার-রাসেল-হোসেইন ও ব্রাভো ১টি করে উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা হন পুরান।
আগামী ২ নভেম্বর গ্রুপ পর্বে নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ। আর ৪ নভেম্বর নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে লড়বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।