প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদারের উচিত জনগণের ঝুকিঁপূর্ণ জীবন, অভিন্ন আশাআকাক্সক্ষা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি দেয়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং উন্নত দেশগুলোর উচিত তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং নৈতিক ও আইনী বাধ্যবাধকতা পালন করা ।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ‘প্রথম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অর্থ সম্মেলন’ (সিভিএফ) এর উদ্বোধনকালে একথা বলেন। তিনিই এই ফোরামের সভাপতি।
অর্থমন্ত্রী এএইচএম মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে, বাংলাদেশ আয়োজিত এই প্রথমবারের মত ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি দেশের (ভি-২০) অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, সিভিএফ-ভি টুয়েন্টি গ্রুপের ৪৮ সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে বৈশি^ক নিঃস্বরণের মাত্র ৫ শতাংশ নিঃস্বরণের জন্য দায়ী। অথচ তারাই এই মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।
এছাড়াও, লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্থ করার মাধ্যমে চলমান কোভিড-১৯ মহামারী নতুন করে দুঃখ কষ্ট যোগ করেছে, বলেন তিনি।
মানব ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি আরো বলেন, ‘চলমান ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলায় আমাদের অবশ্যই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’
সিভিএফ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেন, যেখানে তিনি প্রথম উল্লেখ করেন যে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে রাখতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন রোধে প্রতিটি দেশকে উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য অনুসরণ করতে হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবটিতে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোকে সিভিএফ-ভি ২০ দেশের সবুজ পুনরুদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি এবং মূলধনের ব্যয় হ্রাসে অব্যাহত সমর্থন এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, তহবিলের প্রবাহ অবশ্যই অনুমানযোগ্য, ভারসাম্যপূর্ণ, উদ্ভাবনী এবং বর্ধনশীল হতে হবে, তিনি বলেন, উন্নয়ন অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো তহবিল বরাদ্দ এবং বিতরণে ব্যবহারকারী-বান্ধব প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে এবং বিভিন্ন জলবায়ু তহবিলের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
স্মার্ট ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম ভর্তুকি প্রবর্তনে আর্থিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা তাঁর চতুর্থ প্রস্তাবে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু রক্ষায় ধনী দেশগুলোকে অবশ্যই বিদ্যমান অর্থনৈতিক দূরত্ব ঘুঁচিয়ে সিভিএফ-ভি২০ দেশগুলোর সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরো বলেন, চূড়ান্তভাবে, প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ আমাদের ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানের মতো একটি ‘জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গ্রহণের কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান প্রস্তুত করছে এবং ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত-বার্ষিকী উপলক্ষে এ বছর আমরা দেশব্যাপী প্রায় ৩০ মিলিয়ন চারাগাছ রোপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও, তাঁর সরকার একটি নিরাপদ, সুরক্ষিত, জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ প্রস্তুত করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের আওতাধীন নতুন সিভিএফ-এর এবং ভি২০ জয়েন্ট মাল্টি-ডোনার ফান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দাতা দেশ।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ একটি ‘প্ল্যানেটারি ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও এ ধরনের পদক্ষেপ আশা করছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশ ‘খুরুশকুল স্পেশাল শেল্টার প্রোজেক্ট’ নামে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জালবায়ু শরণার্থী পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে ১৩৯-সুউচ্চ-ভবনগুলোতে ৪ হাজার চারশ ৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হবে।
তিনি আরো বলেন, সিভিএফ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে একটি টেকসই জলবায়ু সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং এরপর জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ব্যবস্থা থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির দিতে এগুতে একটি নতুন জলবায়ু সমৃদ্ধ কার্যক্রম শুরু করেছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতির পিতার জন্ম শত-বার্ষির্কীর সম্মানে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান-ডিকেড ২০৩০’ ঘোষণা করতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।’
প্রধানমন্ত্রী কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যক্রমের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সুবিবেচক হতে হবে এবং একটি টেকসই জলবায়ু সহনশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে।’
তিনি জলবায়ু সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক সমাধান বের করতে সকল অর্থমন্ত্রী, উন্নয়ন অংশীদার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বহু-জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
জলবায়ু ঝুঁকির সূচক ২০২০ এর মতে-বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি ও দীর্ঘ-স্থায়ী বন্যা ও ২০২০ সালে আঘাত হানা সুপার সাইক্লোন আম্পানের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এবং স্থানীয়-নেতৃত্বাধীন অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্বের অন্যতম আসনে রয়েছে। বাংলাদেশে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় অবস্থিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর আমরা আমাদের জিডিপি’র প্রায় ২.৫ শতাংশ বা প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই জলবায়ু সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যয় করি।
তিনি বলেন, চলমান বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে তাঁর সরকার ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২৩টি পুনরুদ্ধার প্যাকেজ চালু করেছে। এটা জিডিপি’র আনুমানিক ৪.২ শতাংশ।
সিভিএফ দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনি গুতেরেজ কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভান ডুক মারকিজ, ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট সাহলে-ওয়ার্ক জেভেডে, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট কার্লোস আলভারাদো কাসাদা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ক্রিস্টোফার লোয়াক, জলবায়ু সংক্রান্ত প্রেসিডেন্সিয়াল দূত জন কেরি, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রেসিডেন্ট মাসাতাসুগু আসাকাওয়া এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের সভাপতি ভার্নার হোয়রেরে প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশনের চেয়ার বান কি-মুন, ভি২০ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীগণ, জি৭ভুক্ত ও জি২০ভুক্ত দেশগুলো দেশগুলোর মন্ত্রী ও প্রতিনিধিগণ আইএফআইএস ও এমডিবিএস এর প্রধানগণ এবং অংশীদারগণ অন্যান্যের মধ্যে এই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন।
সুত্রঃ বাসস