ক্রমেই দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা।
চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। আর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ১৬৩ জন।
এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে মশক নিধন কার্যক্রম না চালানো, ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনের সময় সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমে ভাটা এবং মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসকদের অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে, দীর্ঘ দুই যুগেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে গড়ে ওঠেনি সমন্বিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সবার সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক হাজার ৫৫ জন এবং মারা যান ১৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন এবং মারা যান তিনজন। মার্চে ৩১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন, মারা যান পাঁচজন। এপ্রিলে ভর্তি হন ৫০৪ জন এবং মারা যান দুজনে।
মে মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৪৪ জন এবং মারা যান ১২ জন। জুনে ভর্তি হন ৭৯৮ জন এবং মারা যান আটজন। জুলাইয়ে ভর্তি হন দুই হাজার ২৬৯ জন এবং মারা যান ১২ জন। আগস্ট মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ছয় হাজার ৫২১ জন এবং মারা যান ২৭ জন। সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৯৭ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়। আগের বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ৮৬৮ জন মারা যান। চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর হার কম হলেও সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা, বেড়েছে মৃত্যুও।
চলতি বছর বর্ষা শেষ হলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়তে পারে বলে আগাম সতর্কবার্তা জানিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ এবং কীটতত্ত্ববিদেরা। এ সতর্কবার্তা আমলে না নেওয়া, দৃশ্যমান কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোন কোন জায়গায় ঘাটতি রয়েছে, জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু বাড়বে- এমন পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। এবার বর্ষা একটু দেরিতে শুরু হয়েছে, তাই ডেঙ্গুর প্রকোপও শুরু হয়েছে দেরিতে। আমরা ভয় পাচ্ছি, এবার ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হবে। ডেঙ্গু যে হারে বাড়ছে, তা বিপদজনক। আমরা জানি, যদি এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে ডেঙ্গু বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উদ্যোগের প্রথমটি হলো এডিস মশা নির্মূল। এ কাজটি করে স্থানীয় সরকার, বা অধীনস্থ সংস্থাগুলো। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনসহ সব জায়গায় পালাবদল হয়েছে। নতুন দায়িত্বে যারা এসেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো তারা পুনরুজ্জীবিত করতে পারেননি। ফলে মশা বাধাহীনভাবে বেড়েছে।
এ জনস্বাস্থ্যবিধ আরও বলেন, আমাদের দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। প্রায় ২৪-২৫ বছরেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় কোনো পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় সরকার সারা দেশে, স্বেচ্ছাসেবক এবং জনসাধারণকে যুক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। বর্তমানে সংস্কারের যে সরকার এসেছে, তাদের জনসম্পৃক্ত মশক নিধন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে। অন্যথায় সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য দুঃসহ অভিশাপ হয়ে আসবে।
এ নিয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। মশার ঘনত্ব যেহেতু বাড়ছে, সামনের দিনগুলোতে এডিস মশার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যদি আমরা এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুই মাস আগে থেকে বলে আসছি, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কিন্তু স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়া ডেঙ্গুর পিক টাইমেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। হেলাফেলা করায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ৪৪ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। মশা নিধন কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির এবং ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীর ফোন নাম্বারে কল দিয়েও সাড়া মেলেনি।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
তিনি বলেন, লোক দেখানো কাজ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।