ফার্মারলি। উচ্চশিক্ষিত ৫ তরুণের গড়া দেশের প্রথম কৃষিভিত্তিক মাল্টিভেন্ডর মার্কেটপ্লেস। এখানে পাওয়া যায় রেডি টু কুক- মাছ, মাংস, ইনডোরপ্লান্টসহ যাবতীয় কৃষিপণ্য। কৃষিভিত্তিক মাল্টিভেন্ডর এ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে দেশের যে কেউ যেকোনো প্রান্ত থেকে ১৮টি ক্যাটেগরিতে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় সুবিধা নিতে পারেন বিনামূল্যে। এছাড়াও বিক্রেতারা তাদের বিক্রয় নথির ওপর ভিত্তি করে এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত বিক্রেতাদের বিনিয়োগ দিয়ে সহযোগিতা করে প্রতিষ্ঠানটি। গত সেপ্টেম্বর থেকে ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত হওয়া এ মার্কেটপ্লেস বাজারে আসার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাইলটিং সম্পন্ন করে।
ফার্মারলির শুরুর কথা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও নাজমুল হক নিয়ন বলেন, মালয়েশিয়ায় ইউসিএমে পড়াশোনার সময় এক বিকেলে হোস্টেলের সামনে ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় মূলত আইডিয়াটা মাথায় আসে। সেখানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, ঘানাসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিল এবং আমরা সবাই থাইল্যান্ডের আম খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে আমি বললাম, ‘এর চেয়ে ভালো আম বাংলাদেশে হয়।’ তখন গুগল করে বাংলাদেশের আম দেখে তারা। ঘানার এক শিক্ষার্থী বলে, ‘তোমাদের আমে তো আঁশ আছে, আমাদের আমে আঁশও নেই।’ সেদিন মজার ছলে বলেছিলাম, ‘চলো তোমার দেশে আম বাগান করি।’ তারপর প্রস্তাব হলো যেদেশে যে ফল ভালো হয় সেই দেশে আমরা সেই ফলের একটি করে বাগান করব। পরবর্তী সময়ে সবার কোর্স হয়ে গেলে সবাই যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে যায়। আমি সেই চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে ফার্মারলির বর্তমান টিমের সঙ্গে ব্রেইনস্ট্রিমিং শুরু করি। কিন্তু প্রথমেই ফলের বাগান করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল হওয়ায় আমার পরিকল্পনা পরিবর্তন করে সবজি উৎপাদন ও মার্কেটপ্লেস শুরুর চিন্তা করি। ২০২১ সালের আগস্টে আমরা ফুলকপি প্রজেক্ট দিয়ে আমাদের প্রথম কার্যক্রম শুরু করি।
কৃষিভিত্তিক পণ্যের সেলার ও বায়ারদের একটি কমন প্ল্যাটফর্মে এনে দেয় ফার্মারলি। একজন বায়ারের অনেক বেশি ওয়েবসাইটে সাইনআপ বা অনেক বেশি ফেসবুক পেইজ, গ্রুপে যুক্ত থাকার প্রয়োজন নেই। এখানে যিনি একবার প্রবেশ করবেন তিনি তাঁর গ্রোসারিসহ কৃষিপণ্য সহজেই ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন। বাড়ির আঙিনা বা শহরের ছাদবাগানিদের জন্য একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম ফার্মারলি। সাধারণত নারীরা আঙিনা বা ছাদবাগানগুলো বেশি করে থাকে। তারা যাতে খুব সহজেই ঘরে বসে ভালো বীজ, কম্পোস্ট সারসহ গার্ডেনিং টুলস ক্রয় করতে পারে। এছাড়াও আঙিনা বা ছাদবাগানের উৎপাদিত পণ্য পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পর কিছু কিছু প্রতিবেশীর কাছে বিক্রি করতে পারবে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা আঙিনা বা ছাদবাগানের কীটনাশকমুক্ত সবজি ক্রয় করতে পারেন তাদের গর্ভকালীন অবস্থায়। সেলার ও বায়াররা বাগানের জন্য গাছের চারা অথবা ঘরের জন্য ইনডোরপ্লান্ট ক্রয়-বিক্রয় করতেও পারবেন এখানে। এ ছাড়াও এখানে পণ্য বিক্রেতারা ভবিষ্যতে তাদের ব্যবসা বড় করার জন্য শুধু সেলস ডেটার ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের আবেদন করতে পারবেন।
যেভাবে যুক্ত হতে পারবে তরুণ উদ্যোক্তারা
তরুণদের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নাজমুল হক নিয়ন বলেন, তরুণদের জন্য একটি আদর্শ মার্কেটপ্লেস ফার্মারলি। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। হাতের কাছেই কৃষিপণ্যের সহজ সোর্স। পড়াশোনা শেষ হয়েছে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন যেকোনো তরুণ-তরুণী নিজের বাসা, মেস থেকে কৃষিপণ্য প্রসেস ও ভ্যালু এড করে ফার্মারলিতে সেলার হিসেবে আশপাশের প্রতিবেশী, আবাসিক এলাকা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থিত শিক্ষার্থীদের রেডি টু কুক মাছ, মাংস বিক্রয় করতে পারেন। বিশেষ করে, শিক্ষিত নারী, যারা বিভিন্ন কারণে অফিস জব করছেন না তারা খুব সহজেই হোমবেইজড জব সৃষ্টি করতে পারেন।
বিশেষ সুযোগ পাবেন যারা
১৫০ জন তরুণ এরই মধ্যে ফার্মারলিতে বিক্রেতা হিসেবে যুক্ত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ২০ থেকে ৩১ বছর। এ ছাড়াও পাইলটিং শেষ হওয়ার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ ক্রেতা রেজিস্ট্রেশন করেছেন এবং ফার্মারলির মাধ্যমে বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করেছেন। প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও ফার্মারলিতে অনেক তরুণ এফিলিয়েট মার্কেটিং করে আয় করছে। কোনো তরুণ যদি মনে করে, তার কাছে পণ্য সেল করার মতো পুঁজি বা পণ্যের সোর্স নেই তবে সে এফিলিয়েট অ্যাকাউন্ট করে এবং তার পরিচিতজনের মাঝে শেয়ার করে প্রতি মাসে ভালো আয় করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নাজমুল হক নিয়নের জন্ম কুড়িগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন ইউসিএম বা ইউনিভার্সিটি সেইন্স ইসলাম মালয়েশিয়া থেকে। প্রতিষ্ঠানটির কো-ফাউন্ডার ও সিটিও সঞ্জয় কুমার পালের বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়। পড়াশোনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গে। দলের অন্য তিন সদস্যের একজন তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালী। পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বিবিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ। সৈয়দ মোমেনুজ্জামানের বাড়ি ঝালকাঠি। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইক থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। আর চাঁন বাদশার বেড়ে ওঠা ঢাকায়। জাপানের সমেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে মনোযোগ দেন ফার্মারলিতে ।
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে নাজমুল হক নিয়ন বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এগ্রো-ইকোসিষ্টেম হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি আমরা। এখানে মানুষ কৃষিভিত্তিক সব পণ্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারবে। এছাড়াও ফার্মারলি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও নিজেদের
সেবার পরিধি বাড়াতে কাজ করছে। তাছাড়া আমরা ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষি পরিস্থিতি বুঝে কৃষিখামার, ফলবাগানসহ অন্যান্য প্রজেক্টে হাত দিচ্ছি। একদিন নিশ্চয়ই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব দেশের তরুণদের সঙ্গে নিয়ে।