দেশজুড়ে ফের উদ্বেগজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সকলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পাড়লে ভয়াবহ বিপর্যয় এবং বিগত দিনের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞবৃন্দ।
সোমবার (১৯ জুন) রাজধানীর শিশু হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট চারজন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে মোট ১৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন। চলতি বছরে মোট ৬৩ জন ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
এদিন রাজধানীর সোহরাওরার্দী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় চারজন রোগী ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাধীন ১৭ জন। এ বছর মোট ৭৬ জন রোগী এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়াও মুগদা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড মেডিকেল কলেজে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৪ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন এবং চিকিৎসাধীন ২৮৪ জন।
তবে চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্যবিদরা প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রদান করা তথ্যের থেকে আরও কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করেন।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মোট ২৮১ জন মারা যান এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল মোট এক হাজার ৮৯ জন এবং এক জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট পাঁচ হাজার ২৩১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। মার্চ মাসে কেউ মারা যায়নি, এপ্রিল ২ এবং মে মাসে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। জুন মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ২৩ জন এবং সর্বমোট চলতি মোট ৩৬ জন মারা গেছেন। গত বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তুলনায় এবারের সংখ্যা প্রায় পাঁচগুণ আর মৃত্যুর দিক থেকে ৩৬ গুণ।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, মানুষের অচেতনতা ও গৎবাঁধা কার্যক্রমের কারণেই এ সমস্যার কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ না করলে সামনে আরেকটা বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করছে বলেও অনেকে মনে করছেন।
এ বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এখন সারা বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে। শীতকালেও ডেঙ্গুর বিরাম ছিল না। পাশাপাশি এখন শুধু বৃষ্টির পানিতেই নয় যেকোনো পরিষ্কার পানিতেও ডেঙ্গু হয়। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এলাকা ডেঙ্গু আক্রান্ত। আমরা বিভিন্ন সময়ে পানি খেয়ে প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দিচ্ছি। অর্ধেক পানি খেয়ে বোতল ফেলে দিচ্ছি, বিভিন্ন ধরনের কৌটা যেখানে সেখানে ফেলে রাখছি। বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে, সেখানে পানি জমছে। ফলে এসব স্থানে ডেঙ্গু জন্মাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সারা বাংলাদেশের লোকজন মিলে যদি আমরা ডেঙ্গুর পরিচ্ছন্নতা অভিযান না চালাই, সামনের দিন ভয়াবহ হবে। ষাটের দশকে ম্যালেরিয়া নির্মূলে অভিযান চালিয়ে নির্মূল করা হয়েছিল। তাহলে এখন স্বাধীন দেশে আমরা কেন এটা করতে পারবো না? সব মানুষকে একত্রিত করে এটা করা সম্ভব। এটা শুধু কয়েক মাসের বিষয় নয় কম করে হলে পাঁচ বছরব্যাপী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তাহলে আমরা ডেঙ্গু থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুগুলো রোধ করতে পারব। ডেঙ্গুতো আর বাংলাদেশে নতুন নয়। এটা কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয় সেটাও আমাদের জানা আছে। সুতরাং সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে আরও বেশি বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উল্লেখ করে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। বর্তমানে ডেঙ্গুর ধরন বদলে গিয়েছে। এবারের ডেঙ্গু আক্রান্তদের রোগের তীব্রতা, জটিলতা এবং মৃত্যুর হার বেশি ২০১৯ সাল থেকে বেশি। অন্যদিকে ডেঙ্গুর লক্ষণের ধরনগুলোও বদলে গিয়েছে। ২০১৯ সালের আগে সাধারণত যেসব মশা বাড়ি ঘরে জন্ম নিতো বা বসবাস করত, সেগুলো ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়াত। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে বন্য মশাও এডিসের বাহক হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আবাসিক এবং বন্য দুই মশাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই কারণেই আমরা বলছি তিন চার দিনের একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া দরকার। শুধু মানুষের বাড়ি-ঘর নয়, আশপাশের ঝোপঝাড় এবং জঙ্গলেও মশা মারার ওষুধ ছিটাতে হবে। মশা মারার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকদিন থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। কিছুদিন আগেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে মশা মারার ওষুধ কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। মশা মরে এমন কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। আমরা মনে করি পুরো কার্যক্রমের সাথে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে হবে। যদি জনপ্রতিনিধি সহ সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা না হয় তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।