ভারতের সিকিম রাজ্যের দক্ষিণ লোনাক হ্রদের বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা–সংলগ্ন এলাকায়। তার রেশ কাটতে না–কাটতেই উদ্বেগ বাড়িয়েছে সেই উত্তর সিকিমেরই সাকো–চো হ্রদ। এ ব্যাপারে সিকিম রাজ্যের প্রশাসন মুখে কুলুপ আঁটলেও হ্রদটির আশপাশের এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সিকিম প্রশাসন সূত্রেই খবর, হ্রদ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে লাচেন উপত্যকার থাঙ্গু, চেলা ও ইয়াথাংয়ের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খালি করে দেয়া হয়েছে গ্যাংটকের সিংতামের গোলিতার, মঙ্গনের দিকচু এবং পাকিয়ংয়ের রংপো আইবিএম এলাকা। দিন দুয়েক আগে উত্তর সিকিমের মঙ্গনের পুলিশ প্রশাসনের তরফেই এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।
সিকিম প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতের পর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় স্যাটেলাইটে নজরদারি শুরু হয়েছে সাকো–চো হ্রদের উপরে। হ্রদটি উত্তর সিকিমের ১৬,৪০৪ ফুট উচ্চতায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হ্রদটি দক্ষিণ লোনাকের চেয়ে আয়তনে কম হলেও গভীরতা অনেক বেশি। স্যাটেলাইট নজরদারিতে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনে সেটির পানিস্তর প্রায় ছয় মিটার বেড়েছে। এতেই অশনিসঙ্কেত দেখছেন অনেকে। শুধু তা–ই নয়, ৫৯৪ ফুট গভীর সাকো–চো–র উপরে রয়েছে এক হাজার মিটার উচ্চতার একটি হিমবাহ। বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, উষ্ণায়নের কারণে ওই হিমবাহে ভাঙন ধরেছে। বরফগলা পানিতে হ্রদের গভীরতা সম্প্রতি আরো বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমাগত পানির চাপে যেকোনো মুহূর্তে হ্রদটি ফেটে যেতে পারে। তাতে ‘গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ হওয়ারও প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে। কারণ, আকস্মিক পানিস্ফীতি হলে ডুয়ার্সের নদীগুলোও ছাপিয়ে যাবে। আর ডুয়ার্সে যদি বন্যা হয়, তা আরো বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শিলংয়ের নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির ভূগোল বিভাগের গবেষক অরিন্দম চৌধুরী বলেন, ‘সাকো চো হ্রদ হলো একটি হিমবাহ হ্রদ, যা মাউন্ট কাংচেংইয়াও–র দক্ষিণ–পশ্চিম পাদদেশে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা ৬৯০২ মিটার। উত্তর সিকিমে একটি সম্ভাব্য বিপজ্জনক হিমবাহ হ্রদ হিসেবেই বিবেচিত। জিওকার্টো ইন্টারন্যাশনালে (লন্ডনে প্রকাশিত জার্নাল) প্রকাশিতও হয়েছিল ২০২২ সালে। বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ প্রফেসর সুনীলকুমার দে (এনইএইচইউ, শিলং) এবং প্রফেসর মিলাপ চাঁদ শর্মা (দিল্লির জেএনইউ)-এর অধীনে গবেষণা হয়েছিল। লাগাতার বৃষ্টির কারণে হ্রদের জলস্তর বৃদ্ধি পায়। ফলে মোরাইন বাঁধের উপর আরও জলের চাপ তৈরি হতে পারে। তাতে বাঁধ ভেঙে আর একটি গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড ইভেন্ট তৈরি হতে পারে।’
যদিও সিকিম প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘নতুন করে কোনো উদ্বেগের খবর আসেনি। সিকিম সরকার অবশ্য তিস্তায় পানি বৃদ্ধির আশঙ্কায় দুর্যোগের পর থেকে সর্তকতা জারি রেখেছে। বিভিন্ন লেকের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
সরকারি সূত্রের খবর, শুক্রবারই সিকিমের হ্রদের বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখার জন্য ‘ইন্টার মিনিস্টিরিয়াল সেন্ট্রাল টিম’ তৈরি করেছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালে সিকিম সরকারকে লোনাক হ্রদ নিয়ে প্রথমবার সতর্ক করেছিল হায়দারবাদের ন্যাশনাল রিমোট সেনসিং সেন্টার বা এনআরএসসি। ২০১৭ সালে ওই হ্রদ থেকে পানিও বের করেছিল সিকিম। তার পর আর কিছু হয়নি। ওই তথ্য গত বুধবারই দিল্লিতে পৌঁছেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বের বৈঠকে ওই সবই উঠে এসেছে। সেখানে নতুন করে সাকো–চো–কেও বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে প্রশাসনিক সূত্রের দাবি।