দেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে চালু করা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত পেনশন স্কিমের আওতায় এসেছেন ১২ হাজার ৯৭০ জন, যাঁরা হিসাব (অ্যাকাউন্ট) খুলে চাঁদা পরিশোধ করেছেন। এ সময় টাকা জমা পড়েছে সাত কোটি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস করা হয়। গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরই সবার জন্য সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উন্মুক্ত করা হয়।
পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা।
তবে এই মুহূর্তে অ্যাকাউন্ট খোলার চাইতে পেনশন স্কিম নিয়ে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছানোটাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন তিনি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এক মাস কিন্তু খুব বেশি সময় না। একদম প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত যদি মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারি, প্রবাসীদের কাছে যদি পৌঁছাতে না পারি, তাহলে তো আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশার সুযোগ নেই। আমরা এখন সে চেষ্টাটাই করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি স্কিমের জন্য এক মাস বেশি সময় না। যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদে যুক্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে আরো প্রচারণার দরকার আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ স্কিম করার আগে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাও হিসাব করছে। মানুষকে সময় দিতে হবে, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে এটা বাড়বে।’
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, পৃথিবীর বহু দেশেই চালু আছে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা। যেগুলো চলছে ঠিকঠাক। বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন খাতে জমা হওয়া অর্থ যাবে লাভজনক বিনিয়োগে, তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই জমা হবে স্কিমের হিসাবে। ফলে বেগ পোহাতে হবে না খুব একটা। আর পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে এখন মোট চারটি ধরন—প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। একেক স্কিম একেক শ্রেণিকে লক্ষ্য করে তৈরি, তাই চাঁদার পরিমাণও একেক রকম। তবে এর মধ্যে প্রগতি স্কিমেই সবচেয়ে বেশি অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে। প্রগতি স্কিমের মোট অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ছয় হাজার ১৭৬টি। এই স্কিমটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এ ক্ষেত্রে তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে দুই হাজার, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে। উদ্বোধনের সময় সরকার মোট ছয়টি স্কিমের কথা ঘোষণা করে। তবে আপাতত বাকি দুটি চালু করার কোনো লক্ষ্য নেই বলে জানিয়েছেন গোলাম মোস্তফা।
পেনশন সম্পর্কিত যেকোনো তথ্যের জন্য সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা একটি কল সেন্টার চালু রাখছে কর্তৃপক্ষ। যেকোনো মোবাইল নম্বর থেকে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে যেকোনো নাগরিক এই স্কিমের খুঁটিনাটি জেনে নিতে পারবেন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সুবিধা দিতে পেনশনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বিশেষ করে, গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা দেবে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা।
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব শ্রেণি-পেশার নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অংশ হতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক। তবে ব্যতিক্রম আছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তাঁরা চাইলে পাসপোর্ট দিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তার কপি জমা দিতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য upension.gov.bd ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ব্যক্তি তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর এবং ই-মেইল দিয়ে কয়েকটি ধাপে নিবন্ধন করবেন। এ সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দরকার হবে। কেউ চাইলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি করতে পারবেন। মাসিক চাঁদা ছাড়াও কেউ চাইলে তিন মাস পর পর বা বছরে একবার পুরো চাঁদা দিয়ে দিতে পারবেন। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে তার পরের এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা পরিশোধ করা যাবে।
এর পর থেকে প্রতিদিনের জন্য এক শতাংশ বিলম্ব ফি যুক্ত হবে। কেউ টানা তিন কিস্তি পরিশোধ না করলে তাঁর অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হয়ে যাবে। অনলাইন এবং যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। আপাতত শুধু সোনালী ব্যাংকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের হিসাব খোলা হয়েছে। কেউ চাইলে সরাসরি সোনালী ব্যাংকে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন ও চাঁদা দিতে পারবেন। যাঁদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে তাঁরাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি পেনশন পাবেন টানা ১০ বছর চাঁদা দিয়ে যাওয়ার পর। অর্থাৎ স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাঁকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বছর বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন। গেল ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ স্কিম সাড়ম্বরে উদ্বোধন করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন প্রাহক। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তাঁর নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন ১৫ বছর।
পরবর্তী সময়ে শ্রমজীবী ও শিক্ষার্থীদের জন্য আরো দুই ধরনের প্যাকেজ চালু করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শনিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এই স্কিম থেকে যদি ভালো পরিমাণ টাকা ওঠে, তাহলে আমরা এখান থেকে ঋণ করতে পারব উন্নয়ন খাতের জন্য।’