অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক—নামগুলো কি কোনো অনুরণন তোলে! বলুন তো, কী মিল তাঁদের মধ্যে? বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনে প্রশ্নটা মনে হয় বড় সহজ হয়ে গেল। মনে মনে হয়তো বলেও ফেলেছেন, আরে, এটা কে না জানে! পাঁচটি বিশ্বকাপ জেতা চার অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের নামই তো লিখেছেন।
তাঁদের পাশে প্যাট কামিন্সের নামটা বসিয়ে দিন এবার। মানে কী, এখনই কীভাবে বসিয়ে দেওয়া যায়! অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জিতে গেছে নাকি! তা জেতেনি। তবে যদি অস্ট্রেলিয়াই বিশ্বকাপ জেতে, প্যাট কামিন্সের নামটা তো ওই চারজনের পাশেই বসবে। কেমন দেখাবে সেটি? ওই চারজনের পাশে মানাবে প্যাট কামিন্সের নাম?
বোর্ডার-স্টিভ ওয়াহ-পন্টিং নামগুলোতেই ‘অধিনায়ক’ কথাটা প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই তিনজনের মতো অতটা না হলেও মাইকেল ক্লার্কের নামেও। প্যাট কামিন্সের কথা বললে প্রথমেই কি অধিনায়ক কথাটা মনে হয়? হয় না। কারণ, প্যাট কামিন্স প্রথাগত অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক নন। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হবেন ডাকাবুকো, প্রতিপক্ষের দিকে কথার তির ছুড়বেন, ম্যাচের আগে খেলতে শুরু করবেন মাইন্ড গেম…কই, প্যাট কামিন্স তো এসবের ধারেকাছেও নেই।
চেহারা-ছবি নায়কের মতো। তার ওপর আবার ফাস্ট বোলার। তারকা হতে আর কী লাগে! কিন্তু প্যাট কামিন্স তো এখানেও ব্যতিক্রম। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাদের নাম বলতে বললে প্রবল সম্ভাবনা আছে তাঁর কথা ভুলে যাওয়ার। ওয়ানডে ক্রিকেটে এমন কোনো বড় নাম নন। টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতেও তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই। সেই প্যাট কামিন্স এখন কড়া নাড়ছেন অমরত্বের দরজায়। বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নেওয়া মানে তো অমরত্বই।
তাঁর অধিনায়ক হওয়াটাই ছিল বড় এক বিস্ময়। ফাস্ট বোলাররা ভালো অধিনায়ক হন নাকি! কেলেঙ্কারিতে টিম পেইনের বিদায়, অ্যারন ফিঞ্চের অবসর নিয়ে ফেলা—সবকিছু মিলিয়ে অনেকটা আর কোনো বিকল্প না পেয়েই অধিনায়ক করা হয়েছিল কামিন্সকে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে এটাও একটা ব্যতিক্রমই বলতে হবে। সেখানে তো এক অধিনায়ক থাকতে থাকতেই সবাই জানেন পরের অধিনায়ক কে। মার্ক টেলর থাকতেই স্টিভ ওয়াহ, স্টিভ ওয়াহ থাকতেই রিকি পন্টিং, পন্টিং থাকতেই ক্লার্ক, ক্লার্ক থাকতেই স্টিভ স্মিথ।
স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারিতেই প্রথম ছেদ পড়েছে সেই ধারাবাহিকতায়। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, যে মুকুট মাথায় পরার স্বপ্ন নিজেও দেখেছিলেন কি না সন্দেহ। তাঁর নেতৃত্বেই ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ২-০–তে পিছিয়ে পড়েও ড্র করেছে অ্যাশেজ। এখন ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালেও নিয়ে গেছেন দলকে। কামিন্স নিয়ে গেছেন বললে কী একটু কেমন কেমন শোনাচ্ছে?
ওই যে বললাম, অধিনায়ক বললেই তাঁর চেহারাটা চোখে ভাসে না। তার ওপর এই বিশ্বকাপে ব্যাটিং-বোলিংয়ে সেরাদের মধ্যেও তাঁর নাম নেই। তারপরও এটা প্যাট কামিন্সেরই দল এবং অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালে ওঠায় অধিনায়কের ভূমিকাও আছে। যদিও তা তেমন উচ্চকিত নয়। স্টিভ ওয়াহ-রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া দল শুধু ম্যাচই জিতত না, ঠান্ডা একটা অনুভূতিও ছড়িয়ে দিত প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায়। এই অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই সেখানে পিছিয়ে। তবে বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে লড়াই আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সব প্রতিকূলতা উড়িয়ে দেওয়ার চিরন্তন সেই অস্ট্রেলীয় চরিত্র তো আর হারানোর নয়। তা এই দলেও আছে এবং সেটি অধিনায়কের চেয়ে বেশি কারও মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে মনে হয় না।
যেটা তাঁর মূল কাজ নয়, সেই ব্যাটিংয়েই তা বেশি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া যখন ৭ উইকেটে ৯১, তখন দেখেছিলেন কামিন্সকে? নিরুদ্বিগ্ন অবশ্যই নয়, তা কীভাবে থাকবেন! তবে মুখে সেটির ছাপ ফুটে উঠতে দেননি। বরং প্রতিজ্ঞায় চোয়ালটা যে শক্ত, তা বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ওই অতিমানবীয় ইনিংসটা না খেললে অস্ট্রেলিয়া সেদিন জেতে না। কামিন্সের অবদানটাও ভুলে গেলে অন্যায় হবে। ২০২ রানের জু্টিতে তাঁর অবদান মাত্র ১২। কিন্তু ৬৮ বল টিকে না থাকলে কি আর সেদিন অস্ট্রেলিয়া জেতে?
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালটাও ধরুন না। দারুণ এক ক্যাচে ডি কককে ফিরিয়ে দেওয়াটা বেঁধে দিয়েছিল ম্যাচের সুর। প্রথম স্পেলে মার খাওয়ার পর দ্বিতীয় স্পেলে ৩ উইকেট। আসল কাজটা আবারও ব্যাটিংয়ে। স্নায়ুক্ষয়ী রুদ্ধশ্বাস ওই সময়টায় মিচেল স্টার্ককে নিয়ে অবিচল অধিনায়ক আস্তে আস্তে দলকে নিয়ে গেলেন জয়ের বন্দরে (পড়ুন ফাইনালে)। রান করেছেন মাত্র ১৪, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিটি রান একেকটি হীরার টুকরা।
এসব স্মৃতি তো একেবারেই টাটকা, আপনাদের আরেকটু যদি পিছিয়ে নিয়ে যাই। প্রথম দুই ম্যাচে যাচ্ছেতাইভাবে হেরে অস্ট্রেলিয়ার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। শ্রীলঙ্কান ওপেনাররা ১২৫ রান তুলে ফেলার পর তো আরও বেশি। ২২তম ওভারে আক্রমণে ফিরে কামিন্সই ফেরালেন দুই ওপেনারকে। এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ার চেহারায় দেখা দিতে শুরু করার একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের কথা বললেই ফিরে যেতে হয় যেখানে।
না, বিশ্বকাপটা প্যাট কামিন্সের হাতে ভালোই মানাবে। ওই চারজনের পাশে তাঁর নামটাও।