সুন্দরবনের পর দেশে দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওর। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের আধার এই হাওরে একসময় প্রচুর পাখপাখালি দেখা যেত; আর মাছও ছিল প্রচুর।
সেই দিন ফুরিয়েছে। এখন টাঙ্গুয়ার হাওরপারের মানুষ দেশি মাছ পান না। চাষের পাঙাশ মাছ কিনে খান। অথচ বিশেষজ্ঞদের কাছে হাওরটি ‘মাদার অব ফিশারিজ’ নামে পরিচিত। আর হাওরপারের মানুষেরা একে ‘সব হাওরের মা’ বলেন।
বছর বিশেক আগে হাওরটি প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আসে। প্রথম কয়েক বছর এ নিয়ে বেশ তোড়জোড় ছিল। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব হারাতে থাকে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। বিশাল হাওরের দেখভালের জন্য আগে দুই থেকে আড়াই হাজার পাহারাদার (ইজারাদারের লোক) ছিলেন। এখন হাওরের সম্পদ পাহারায় আছেন মাত্র ২৪ জন আনসার সদস্য। এই নগণ্য সংখ্যক মানুষ দিয়ে হাওরটির দেখভাল মোটেও হচ্ছে না বলে অভিমত হাওরপারের সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের। স্থানীয় লোকজন যেমন খুশি তেমন মাছ ধরছেন, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছেন। এগুলো দেখভালের যেন কেউ নেই। হাওরটি এখন অস্তিত্ব-সংকটে ধুঁকছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশাল মৎস৵ভান্ডার শূন্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। হাওর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অভয়াশ্রমগুলোকে ঠিকঠাক সংক্ষণ করতে পারলে হাওরে মাছ বাড়বে। তবে হাওরে যেনতেনভাবে বাঁধ নির্মাণ ও কান্দা কাটা একেবারে বন্ধ করতে হবে। পর্যটকদের ভ্রমণেও স্থান নির্ধারণ করে দিতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকদের প্রিয় জায়গা। শত শত পর্যটক প্রতিদিন শতাধিক নৌকা নিয়ে হাওরজুড়ে ভেসে বেড়ান। এতে হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন অনেকে। নৌকা নিয়ে হাওরেই রাতযাপন করার প্রবণতাও বাড়ছে। এটি একদিকে পর্যটন সম্ভাবনা, অন্যদিকে হাওরে জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসন পর্যটক এবং তাদের বহনকারী নৌযানের অবাধ যাতায়াতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে বাস্তবে বিধি মানা হচ্ছে কমই। হাওরে ফেলা পর্যটকদের বর্জ্যও পরিবেশের ক্ষতি করছে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কাজের ক্ষেত্রে কিছু সংকট, সীমাবদ্ধতা আছে। হাওরে এখন চারদিক থেকে প্রবেশ করা যায়। আমরা এটি বন্ধ করতে চাই। পর্যটকদের জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। হাওরের অভয়াশ্রমগুলোকে সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র৵, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই টাঙ্গুয়ার হাওরে সব কাজ হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সদস্য আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, পর্যটনে নতুন ভাবনায় হাওর-পর্যটন বিকশিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে প্রকৃতিকে প্রকৃত অবস্থায় রাখতে না পারা নিয়ে। হাওরকে হাওরের মতো করে রাখতে না পারলে পর্যটন একদিন পর্যুদস্ত হবে।