প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার রেল যোগাযোগের মাধ্যমে সমগ্র দেশকে কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি রেল পরিষেবা, গতি ও পরিবহনকে বিশ্বমানের করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। আমরা সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কক্সবাজার (রেল সংযোগের মাধ্যমে) যাত্রা সহজ করতে ব্যবস্থা নেব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শনিবার নবনির্মিত রেল স্টেশনের ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে আইকনিক কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনের সাথে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। এর মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো। তিনি বলেন, তিনি নিজেসহ দেশবাসী এখন কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়, রাজশাহী, দেশের দক্ষিণাঞ্চল, সুন্দরবন পর্যন্ত রেলপথ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কেন গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়াকে ছেড়ে দেওয়া হবে তার মানে সারা বাংলাদেশ কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করায় দেশের মানুষ এখন গর্ববোধ করছে। কক্সবাজার রেল যোগাযোগের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই দিনটি গর্বিত হওয়ার দিন। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে পেরে সত্যিই খুব খুশি হয়েছেন। আমি রেলপথ উদ্বোধন করে আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। এটা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সেই দাবি পূরণ হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার অথবার রাজশাহী থেকে কক্সবাজার, দক্ষিণাঞ্চল সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার এমনটি গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই যাতে সহজে কক্সবাজার আসা যায় সেই পদক্ষেপও আমরা নেব। এই যোগাযোগগুলো সম্পন্ন হলে আমাদের পর্যটনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে বলে আমি বিশ^াস করি।
তিনি ছোটবেলা থেকেই স্থানীয় একটি দাবি শুনে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন ছিল। কাজেই এই দোহাজারী থেকে কক্সবাজার কবে রেললাইন আসবে? সেকথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা করতে পারায় তিনি খুবই আনন্দিত। এটা রামু পর্যন্ত করা হয়েছে এবং গুমধুম পর্যন্ত করার কথা। এ জন্য আমরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসতে চাই। ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সাথে আমরা সংযুক্ত হতে চাই। সেটা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই প্রকল্প বাস্তায়নের সময় ৩৯টি মেজর ব্রিজ করতে হয়েছে, ২৪৪টি ছোটও মাঝারি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, ৯টি স্টেশন ও আধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগনালিং ব্যবস্থা ইনস্টল করা হয়েছে। একটি ওভারপাস ও দু’টি আন্ডারপাস ও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই রেললাইনটা চকোরিয়া থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও পাওয়ার পাøান্ট এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথে যাতে সংযুক্ত হয় তার ব্যবস্থাও আমরা করে দেব। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো উন্নত হয়।
তিনি বলেন, তার সরকার ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মিলে সম্প্রতি খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল চলাচলের উদ্বোধন করেছে। যে লাইনটা এক সময় খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
পাশাপাশি ঢাকাণ্ড টঙ্গি-গাজীপুর ডুয়েল গেজ লাইনও নির্মাণ করা হচ্ছে। রেলের যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহনের মানোন্নয়নে আরো ৪৬টি নতুন ব্রডগেজ লোকামোটিভ, ৪৬০টি নতুন যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ২০০টি নতুন মিটার গেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ১৩১০টি নতুন ওয়াগন সরবারহের উদ্যোগও তার সরকার হাতে নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ৩/৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতে উন্নীত হয় সেই পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি এবং সেটা আমরা বাস্তবায়ন করবো।
বিগত ১৫ বছরের বাংলাদেশকে তার সরকার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি আমলে যেখানে ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল সেখানে তার সরকার এবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে।
এমনকি দু’হাতে রিজার্ভের অর্থ ব্যয় করে করোনাকালিন জনগণকে বিনাপয়সায় ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি সকল শ্রেনী পেশার মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রেখেছে। যা অনেক উন্নত দেশও পারেনি। ফলে সেখানে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। এ সময় বিশ^মন্দার প্রভাবে দেশে যেন কখনো খাদ্যাভাব না হয় সেজন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি তার আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন।
এ সময় এত উন্নয়নের পরও যারা উন্নয়ন দেখে না সেসব চোখ থাকতে অন্ধদের তার সরকারের করে দেওয়া আধুনিক জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউটে ১০ টাকার টিকিট কিনে চোখের চিকিৎসা করাবার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, আসলে এটা তাদের চোখের দোষ নয়, মনের দোষ। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা, বাসে, রেলে আগুন দেওয়া হচ্ছে। আমরা রেলের জন্য যেসব নতুন লোকামোটিভ এনেছিলাম সেগুলোও আগুন দিয়ে তারা পুড়িয়েছে। যারা এত বীভৎস কাজ করতে পারে এই দুর্বৃত্তপরায়ণতায় যারা জড়িত তাদের চোখ নয় আসলে মনই অন্ধকার। কাজেই এদের ব্যাপারে সকলকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এরা ধ্বংস জানে সৃষ্টি করতে পারে না। আমরা সৃষ্টি করি, আর তারা ধ্বংস করে। কিন্তু এই ধ্বংস যেন আর করতে না পারে। মানুষকে পুড়িয়ে মারবে এটা সহ্য করা যায় না।
তিনি এই আধুনিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কার্যকরী এবং গতিশীল রাখতে ট্রেনের ক্যারেজ, প্লাটফর্ম, ষ্টেশনসহ আশাপাশে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বজায় রাখার এবং এগুলো ব্যবহারে যত্নবান হওয়ারও আহবান জানান। তিনি বলেন,আপন সম্পদ মনে করে যত্ন নিয়ে এর ব্যবহার করবেন। সারা বাংলাদেশে অনেক রেলস্টেশন রয়েছে। কিন্তু কক্সবাজারের এই ৬ তলা রেলস্টেশনটি সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও সুন্দর। রেল লাইন উদ্ধোধনের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই টিকিট কেটে কক্সবাজার থেকে রামু যাওয়ার ট্রেনে চড়েন। প্রধানমন্ত্রীর হুইসেল ও সবুজ পতাকা নেড়ে ট্রেন চলাচলের যাত্রা শুরু করেন। টেনে চড়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে প্রতিটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। দেশ ও জনগণের উন্নয়নই তার একমাত্র লক্ষ্য উল্লেখ করে সারাদেশে পর্যটন রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের পর্যটন শিল্পকে আরো বিকশিত করার পরিকল্পনাও তার সরকারের রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রেলওয়ের কার্যক্রম এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী রেলস্টেশনে পৌঁছালে স্থানীয় শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানো হয়।
previous post
সম্পর্কিত খবর
- মন্তব্য
- ফেসবুক কমেন্টস