ব্লাকবার্ন রোভার্সের হয়ে প্রিমিয়ার লিগজয়ী পল ওয়ারহার্স্টকে মনে আছে? কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে প্রিমিয়ার লিগজয়ী ডিয়ন ডাবলিন?
দুজনেই মাঠে একাধিক পজিশনে খেলতে পারতেন। ডাবলিন তো ক্যারিয়ারের শেষ দিকে সেন্টার ফরোয়ার্ড থেকে সোজা নেমে এসেছিলেন সেন্টার ব্যাকে। ওয়ারহার্স্ট রক্ষণ, মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ—কোথায় খেলেননি!
তাঁদের দুজনের পর থেকে একাধিক পজিশনে খেলতে পারা ফুটবলারেরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। আধুনিক ফুটবল এখন এমন খেলোয়াড়ই চায়। ম্যাচের মধ্যে যিনি বিভিন্ন পজিশনে মানিয়ে নিয়ে দলের জন্য সেরা অবদানটা রাখতে পারবেন।
ফুলহামের বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগে গত রোববার ম্যাচ শুরুর আগে গ্রাফিকসে দেখানো হয় লিভারপুল তারকা ট্রেন্ট আলেক্সান্দার-আর্নল্ডের পজিশন রাইট ব্যাক। কিন্তু মাঠে তাঁকে সেই পজিশনে দেখা যায়নি। ইনভার্টেট ফুলব্যাক হিসেবে মাঝমাঠে উঠে পাসের পর পাস দিয়েছেন। আবার দুই সেন্টার ব্যাকের মাঝে নেমে এসে বল কুড়িয়ে মাঝমাঠে পাস দিয়েছেন। ইংলিশ এই রাইটব্যাকের পাসিং ক্ষমতা ব্যবহার করে আক্রমণের ধারা পাল্টাতে চেয়েছিল লিভারপুল।
আলেক্সান্দার-আর্নল্ড এবং তাঁর সতীর্থদের লক্ষ্য ছিল ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। ম্যাচ শেষে নিজের একাধিক পজিশনে খেলার ব্যাখ্যাও করেন লিভারপুল তারকা, ‘ব্যাপারটা আমি যেভাবে দেখি এবং আমাকে যেভাবে খেলতে বলা হয়েছে—যখন বল আমাদের পায়ে তখন আমি মিডফিল্ডার এবং বল যখন দখলে নেই, তখন আমি রাইটব্যাক।’
রক্ষণভাগে চতুর্থ একজন খেলোয়াড় রাখলে—ফুলহামের বিপক্ষে যেটা লিভারপুলের ছিল—প্রতিপক্ষ ম্যান-মার্কিং সিস্টেমে আক্রমণ তৈরি করতে গিয়ে বাধা পায়। কারণ, রক্ষণে যাঁর পায়ে বল তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে প্রতিপক্ষ, তাতে অন্য খেলোয়াড়কে মার্ক করা যায় না।
লিভারপুল ৪-৩-৩ কিংবা ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলে। অভিজাত ফুটবলের দর্শকদের জন্য এই ছক বেশ সরল। আর তাই নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিকা তৈরি করে তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চটুকু দলের জন্য ব্যবহার করার ব্যাপারটা কোচের মেধা ও চাতুর্যতার ওপর নির্ভর করে। যেমন ধরুন, ম্যানচেস্টার সিটির জন্য জন স্টোনস যা করেন এবং লিভারপুলে আলেক্সান্দার-আর্নল্ডের ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু তাঁদের স্থানান্তর করা অসম্ভব।
স্টোনস গত নভেম্বরে চোট পাওয়ার পর সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘আমরা সমস্যায় পড়েছি।’ কারণ গার্দিওলা জানতেন, ডিফেন্ডার কাম মিডফিল্ডারের ভূমিকায় অভ্যস্ত স্টোনস সিটির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ম্যানুয়েল আকাঞ্জি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু স্টোনসের পজিশনে খেলার জটিলতা ভেদ করে তাঁর মানে পৌঁছাতে পারেননি।
১৯ বছর বয়সী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রিকো লুইস অবশ্য আশা দেখাচ্ছেন সিটিকে।
সিটির একাডেমি থেকে উঠে এসেছেন রিকো লুইস। গার্দিওলা সিটির দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ১১ বছর। স্প্যানিশ এ কোচ এসেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন আগামী দিনগুলোতে রিকো কীভাবে খেলবেন। তাঁর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময়ও লেগেছে রিকোর। বিশ্বব্যাপী ক্লাবগুলোর বয়সভিত্তিক দলে কোচরা নিশ্চিত করেন, খেলোয়াড়দের মাঠে বিভিন্ন পজিশনের বৈচিত্র্য নিয়ে যেন জানাশোনা থাকে। বিভিন্ন পজিশনে খেললে খেলোয়াড়েরা বুঝতে পারেন, তাঁরা যে পজিশনের খেলোয়াড় নন, সেসব পজিশনে খেলতে হলে কী প্রয়োজন?
তবে একটা সমস্যা থেকেই যায়। একজন খেলোয়াড় তাঁর পজিশন সম্পর্কে যত ভালো ধারণাই রাখুন না কেন, তাঁর সতীর্থদের দায়িত্ব থাকে ওই খেলোয়াড়টি যে পজিশন ছেড়ে নতুন ভূমিকা নিয়েছেন, সেই ছেড়ে আসা পজিশনের শূন্যতা পূরণ করা। ফুলহাম-লিভারপুল ম্যাচের কথাই ধরুন। আলেক্সান্দার-আর্নল্ড যখন মাঝমাঠে উঠেছেন, তখন ফুলহাম আক্রমণে গিয়েছে। রাইটব্যাক পজিশনে ফাঁকা জায়গাটা তারা ব্যবহার করেছে। তাতে নিজেদের প্রথম গোলটাও পেয়েছে ফুলহাম। কেউ ওপরে উঠলে সতীর্থ ডিফেন্ডারদের তখন একটু বুদ্ধি করে খেলতেই হয়, কারণ প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে মাঠে ফাঁকা জায়গা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার।
সে ম্যাচে আলেক্সান্দার-আর্নল্ডের চেয়ে বল বেশি ‘টাচ’ করেছেন শুধু লিভারপুল ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক। লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ দেখেছেন, নিজের নামকাওয়াস্তে পজিশন রাইটব্যাক থেকে ম্যাচে কী দারুণ প্রভাব রাখছেন আলেক্সান্দার-আর্নল্ড। মাঝমাঠে খেলালে তিনি আরও বেশি অবদান রাখতে পারবেন, এমনটাই ভেবেছিলেন ক্লপ। আর জো গোমেজও ফুলব্যাক হিসেবে ভালো করতে পারবেন, সে জন্যই দ্বিতীয়ার্ধে বদলি খেলোয়াড় মাঠে নামিয়েছেন। এতেই বোঝা যায় একজন খেলোয়াড়ের ওপর কোচের কী আস্থা, তা ছাড়া আলেক্সান্দার-আর্নল্ডও সর্বশেষ দুটি লিগ ম্যাচে শেষ দিকে গুরুত্বপূর্ণ গোল পেয়েছেন।
তবে শুধু রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরাই মাঠ চষে বেড়ান না। হাইব্রিড উইঙ্গারেরাও দলকে অন্য মাত্রা দিতে পারেন। দল রক্ষণাত্মক খেলার সময় তাঁদের ভূমিকা থাকে বিস্তৃত, বল দখল করতে হয় এবং ফুলব্যাকদের ওভারল্যাপ করে উঠে যাওয়ার জন্য জায়গাও বের করতে হয়। ফুটবল খেলাটা এভাবেই উঁচু পর্যায়ে আবিষ্কারমনস্ক কোচদের হাত ধরে আরও বিবর্তিত হবে। অনেকেই ‘টোটাল ফুটবল’–এর প্রতিভূ ইয়োহান ক্রুয়েফকে এ ক্ষেত্রে আদর্শ মানেন। আর এভাবেই তাঁরা উত্তরসূরিদের ফুটবলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা কৌশলগতভাবে পাল্টে দিচ্ছেন। আলেক্সান্দার-আর্নল্ড, জন স্টোনসরা প্রমাণ করছেন, তাঁরা কোচদের চেষ্টার সুফল। তাঁদের মতো ফুটবলারদের কোনো পজিশন ছাড়া মাঠে চষে বেড়ানো প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক। কারণ, মাঠে কখন কোন ভূমিকায় তাঁরা আবির্ভূত হবেন, সেটা প্রতিপক্ষের অজানা।
পরবর্তী প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা বিভিন্ন পজিশনে খেলার এই ধারাকে নিশ্চয়ই সামনে আরও এগিয়ে নেবেন। এমন ভূমিকায় শৃঙ্খলা, বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি প্রচুর কৌশলগত জ্ঞানের প্রয়োজন। আর্লিং হলান্ড কিংবা মোহাম্মদ সালাহর মতো স্ট্রাইকারদের তাই স্বর্ণরেণু হিসেবে দেখা গেলেও বিভিন্ন পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত খেলোয়াড়দের মূল্যবান ধাতু হিসেবেই দেখা হবে।